চারটি কবিতা
-সেলিম মিয়া
দরবারি কানাড়া
সকল গল্পের প্লটকে ছাড়িয়ে যে নাছোড় গল্প
কলমের ডগায় আসে সবার আগে
সে গল্প আমি লিখতে চাই না আর।
তবু সে গল্পের দরবারি কানাড়া
মগজের ভেতর ঝনঝনিয়ে বাজে
কিছুতে তারে আমি পারি না কেন ঝাড়তে?
কর্ণাটক হয়ে উত্তর ভারত শেষে বাংলাদেশ
এখন সেই রাগ উত্তর মেরুতে
তুষারপাত হয়ে ঝরে মরা গাছের ডালে ডালে
বরফ-কঠিন এ মধ্য রাতে
কী সুর বাজায় সে এমন বরফের কাচে!
কাচ ভেঙে যায় ঠুনকো চাপড়ে
হিমশীতল জল হয়ে গড়ায় যেন
হৃদয়ে হৃদয়ে, বুকে এসে আটকায়,
চোখে এসে ঝরে তুষার রোদন হয়ে।
তবুও বেজে চলে দরবারি কানাড়া
প্রাণের সবটুকু উষ্ণতা শুষে সে
প্রাণকেই করে যে বরফ-শীতল,
আর অন্তর গহীনে হু হু করে বাজে কনকনে হাওয়া
হাড়গুলো তখন খুঁজে ফেরে রোদ্দুরের উষ্ণ ছোঁয়া।
তবু মোমবাতির আলোর মতো মৃদু ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে
চেয়ে থাকে সূর্য যেন নির্বিকার সারাটি দিনমান!
নিন্দিত জনগণ
যে বার কানাডার উত্তরভূমি থেকেছে নিরুত্তর
শত বছরের রেকর্ড ভঙ্গের তুষার-উৎসবে,
যে বার পৃথিবী ভুগেছে নিদারুণ মন্দায়
কর্পোরেট বাণিজ্য করেছে শ্রমিক ছাঁটাই,
যে বার অসভ্যতার জোরে
বহু দেশ হয়েছে ধ্বংস,
যে কয়বার দেশে দেশে অসহায় প্রাণ হয়েছে নগ্ন হামলার শিকার,
যে কয়বার আরোপিত অন্ধকারে
আফ্রিকা হয়েছে বঞ্চিত সূর্যালোক থেকে,
যে কয় বার বাংলার কোটি কোটি ঘরে সন্তর্পণে ঢুকেছে
শাসকদের শোষণজাত মন্বন্তর,
যে কয়বার চাপাতির খ্যাঁচ খ্যাঁচ শব্দে খুঁজেছে সঙ্গীত
অন্ধ গোঁড়ার দল,
যে কয়বার কয়েক শো নির্দোষ প্রাণ
জ্বীবন্ত কয়লা হয়েছে পেট্রোল বোমায়,
যে বার সাঁওতাল পল্লী পুড়ে
ছাই করেছে দস্যুদের দল,
ততবার হৃদয়কে জিওল-জলে বাঁচিয়ে রেখেছি
একটুখানি দেহ-মনে ভাল থাকবো বলে।
কিন্তু আমাদের ভাল থাকা হয়নি;
আমাদের স্বপ্নময় সুন্দরতম দিনগুলো
প্রতিবারই ঝলসে ফেলানো হয়েছে।
আমাদের কাঙ্খিত কুসুমদল
অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা হয়েছে।
আমাদের অনাগত ভবিষ্যতকে
তুমুল আছাড়ে পঙ্গু করা হয়েছে।
আমরা এখনো শাসক-শোষিত জনগণ!
আমরা এখনো রাজনীতি-পীড়িত জনগণ!
আমরা এখনো জনগণনিন্দিত জনগণ!
নৈঃশব্দের ভাস্কর
কিছু না বলেই
পড়ে গিয়ে
প্রিয় কাচের গ্লাস ভেঙে যাওয়ার মতো করে
তুমিও ভাঙলে তবে এ হৃদয় টুকরো টুকরো করে
তফাৎ রাখলে শুধু শব্দে।
নৈঃশব্দের এমন দক্ষ ভাস্কর তুমি
ঝন ঝন, খচ খচ, ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে
মৌনতাকে কেটে কেটে শিল্প নির্মাণ করো
অথচ কোনো শব্দই তার বাইরে বেজে ওঠে না
শুধু আমার ভেতর-মন্দির ব্যতিরেকে।
অথচ শব্দ বয়ে নেওয়ার মতো
যথেষ্ট বাতাস চারিদিকে।
বুঝবে না তুমি
হেমন্ত-সুবর্ণ সন্ধ্যা লুকায় রাতের বক্ষ মাঝে
শিশির-পূজারী অন্ধকার বন্ধ করে সব দ্বার
আলোকের। চেয়ে চেয়ে দেখে যে বিবর্ণ, শ্রান্ত চাঁদ
ঝাউবন শাখার মাথায় যেথা জমে অবসাদ।
প্রাসাদের আচ্ছাদনে যার ঝলমলে বসবাস
সে কি সত্যি তার কিছু বুঝবে কখনো আর!
তুমি খোলো না জানালা তবে সেই প্রাসাদের
মরি আমি মরণের হয়ে। স্মরণের দরজায়
কতজনই পা মাড়ায় বেলা-অবেলায়!
তোমার আঘাতে দ্বার শুধু ঝুরঝুর ঝরে যায়।
Be the first to comment