ট্রু ট্রাশ
মূল: মার্গারেট এটউড
অনুবাদ: সেলিম মিয়া
খ সাহেব ভোজন প্রার্থনা শেষ করে বসে পড়েন। আর ক্যাম্পাররা প্রতিদিনকার তিন বেলা খাবারের রীতি হিসেবে মুখে রুটি পুরে দেওয়া, টেবিলের নিচে গুঁতাগুঁতি করা, ফিসফিসিয়ে গালিগালাজ করা শুরু করে। রনেট বড় একটা থালায় ম্যাকারনি ও পনির নিয়ে রান্নাঘর থেকে আসে। তার স্বভাবসুলভ বাঁকানো হাসি দিয়ে সে বলে, ‘এই নাও, ছেলেরা।‘
কাউন্সেলর ডার্স প্রতারণামূলক মুগ্ধতার সাথে বলে, ‘অনেক ধন্যবাদ, ম্যাডাম।‘ ছিনালির ব্যাপারে ডার্সের একটা খ্যাতি আছে। ডনি জানে ডার্স রনেটের পিছনে লেগেছে। এ ব্যাপারটা তার খারাপ লাগে। খারাপ লাগে এবং বয়সে খুব বেশি ছোট বোধ করায়। কিছুক্ষণের জন্য সে তার নিজের শরীর থেকে বের হয়ে যেতে চায়। চায় অন্য কেউ হতে।
পরিচারিকারা বাসন-কোসন পরিস্কার করছে। দুজন মাজছে, একজন ধুচ্ছে, একজন সিঙ্কের ত্বক-পোড়ানো গরমে আলতো করে পানি ঢালছে। বাকি দুজন মেঝে ঝাড়ু দিচ্ছে, আর টেবিল মুছছে। ছুটির দিন এলে পরে ড্রাইয়ারের সংখ্যায় হেরফের হবে। তারা দুজন করে ছুটি নেবে যাতে তারা কাউন্সেলরের সাথে দু’বার ডেট করতে পারে। কিন্তু আজ তাদের সবাই এখানে আছে। ঋতুটার প্রথম ভাগ এখন। সব কিছু এখনও তরল তরল। সীমানা এখনও নির্ধারিত করা হয়নি।
কাজের সময় তারা গান গায়। শীতকালের যে সঙ্গীত সমুদ্রে তারা ভেসে বেড়ায় তার খুবই অভাব বোধ করছে তারা। প্যাট ও লিজ দুজনেই তাদের ল্যাপটপ এনেছে। যদিও এখানে রেডিওর সংকেত খুব একটা পৌঁছায় না। তীর থেকে যে অনেক দূরে। কাউন্সেলরের বিনোদন হলে একটা রেকর্ড প্লেয়ার আছে। কিন্তু রেকর্ডগুলো সেকেলে। প্যাটি পেজ, দ্য সিঙ্গিং রেজ, ‘হাউ মাচ ইজ দ্যাট ডগি ইন দ্য উইনডো’, ‘দ্য টেনেসি ওয়োলস’, হু ওয়োলস এনি মোর?
স্যান্ডি গেয়ে ওঠে, “ ‘ওয়েক আপ, লিটল সুসি।‘ “ এবারের গ্রীষ্মে দ্য এভারলি ব্রাদারস জনপ্রিয়। কিংবা জনপ্রিয় ছিল মূল ভূখণ্ডে যখন তারা সেটা ছেড়ে এসেছিল।
অন্যরা গাইতে থাকে, “ ‘হোয়াট আর উই গনা টেল ইউর মামা, হোয়াট আর উই গনা টেল ইয়োর পা।’ “ জোয়ান অলটো হারমনিকে প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সাথে গাইতে পারে। এতে সব কিছুকে কম বাজখাই মনে হয়।
হিলারি, স্টিফ্যানি ও অ্যালেক্স এ গানটা গায় না। তারা বেসরকারী স্কুলে যায়। সবাই মেয়ে। আর ‘ফায়ার’জ বার্নিং’ এবং ‘হোয়াইট করাল বেলজ’ এর মতো কোরাস গান খুব ভালো গায়। তারা টেনিস খেলা এবং নৌকা চালানোতেও ভালো। এসব দক্ষতায় অন্যদের ছাড়িয়ে গেছে।
এটা অদ্ভূৎ ব্যাপার যে, হিলারি ও অন্য দুজন এই ক্যাম্প অ্যাডানাকিতে পরিচারিকার কাজ করছে। এমন না যে, তাদের টাকা দরকার। (জোয়ান ভাবে আমার মতো না যে প্রতিদিন দুপুর হলেই চিঠিপত্রের টেবিলটার দিকে ছুটে যায় কোনও স্কলারশিপ পেয়েছে কিনা দেখতে।) তবে এটা তাদের মায়েদের কাজ। অ্যালেক্সের মতে তিন জন মা মিলে একটা দাতব্য অনুষ্ঠানে খ সাহেবার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার হাত ভেঙে দিয়েছিল। খ সাহেবা স্বভাবতই মায়েদের মতো একই অনুষ্ঠানে যেত। তারা খ সাহেবাকে দেখেছে। কপালের ওপর সানগ্লাস তুলে এবং হাতে মদের লম্বা বোতল নিয়ে খ সাহেবের পাহাড়চূড়ার সাদা বাড়ির বারান্দায় বিনোদিত করছে। বাড়িটা ক্যাম্পের জায়গা থেকে বেশ দূরে। তারা দেখেছে অতিথিরা তাদের নিখুঁত, পরিপাটি নৌ-পোশাক পরে আছে। তারা শুনেছে হাস্যধ্বনি, কণ্ঠস্বর। ফ্যাসফ্যাসে ও সাদামাটা দু’ধরণেরই। ও ঈশ্বর, আমায় বলো না। হিলারির মতো।
অ্যালেক্স বলে, ‘আমাদের অপহরণ করা হয়েছিল। তারা মনে করত ছেলেদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করার জন্য এটাই ভালো সময় ছিল।“
নাদুস-নুদুস ও ঘাড়ত্যাড়া অ্যালেক্সের মধ্যে বিষয়টা দেখতে পায় জোয়ান। দেখতে পায় ছেলেদের মতো করে বড় হওয়া ও হেঁটে বেড়ানো স্টিফ্যানির মধ্যে। কিন্তু হিলারির মধ্যে? হিলারি হচ্ছে ধ্রুপদী। হিলারি হচ্ছে শ্যাম্পুর অ্যাডের মতো। হিলারি নিখুঁত। তার পিছনে সবার ঘোরা উচিৎ। দূর্ভাগ্যবশত, এখানে তার পিছনে কেউ ঘুরছে না।
মাজতে মাজতে রনেটের হাত থেকে একটা থালা পড়ে যায়। বলে ওঠে, ‘ধ্যেঁৎ, কী অবাক কাণ্ড।‘ টিটকারি মেরে হলেও কেউ তাকে চেঁচিয়ে তেমন কিছু বলে না যেমনটা অন্য কাউকে বলে। তাদের সবার প্রিয় সে। কেন প্রিয় সেটা বলা যদিও কঠিন। সেটা শুধু এজন্য না যে, সবার সাথে সে মিশতে পারে। লিজও তো মিশতে পারে। প্যাটও পারে। রনেটের মধ্যে রহস্যময়, অতিরিক্ত কিছু আছে। যেমন ধরেন, সবারই একটা ডাক নাম আছে। হিলারির হিল, স্টিফ্যানির স্টেফ, অ্যালেক্সের অ্যাল, জোয়ানের জো, ট্রিশিয়ার ট্রিশ, স্যান্ডির স্যান। প্যাট ও লিজ যাদের নাম আর ছোট করা যায় না তারা হয়েছে পেট ও লিজার্ড। শুধু রনেটকেই তার পূর্ণ, অপ্রত্যাশিত নামের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।
বাকিদের চেয়ে কোনও কোনও দিক দিয়ে রনেট বেশি পরিণত। কিন্তু সেটা এ কারণে না যে, সে বেশি কিছু জানে। খুব কম জিনিস সম্পর্কেই জানে সে। শব্দের অর্থ খুঁজে পেতে প্রায়শই তার বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে, বেসরকারি স্কুল ত্রয়ীর অপশব্দ। সে বলে, ‘আই ডোন্ট গেট দ্যাট।‘ অন্যরা এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মজা নেয় যেন রনেট বিদেশি কেউ, অন্য দেশ থেকে আসা কাঙ্খিত একজন দর্শনার্থী। বাকি অন্যদের মতোই সে টিভি ও ছবি দেখতে যায়। কিন্তু সে যা দেখেছে সে ব্যাপারে তার মতামত দেয় না বললেই চলে। খুব বেশি বললে বলবে, ‘বাজে’ অথবা ‘সে মন্দ না।‘ বন্ধুত্বসুলভ হলেও কথায় মত প্রকাশের ব্যাপারে সে সতর্ক। ‘মোটামুটি’ হচ্ছে তার বলা সর্বোৎকৃষ্ট প্রশংসা। অন্যরা কী পড়েছে অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরের বছর কোন বিষয় নিয়ে পড়বে সে ব্যাপারে যখন কথাবার্তা বলে, সে তখন নীরব থাকে।
কিন্তু সে অন্য বিষয়ে জ্ঞান রাখে। লুকায়িত, গোপন বিষয়ে। আর এই অন্য বিষয়গুলো একটু পুরানো। কোনও কোনও পর্যায়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বেশি মৌলিক, বেশি অকপট।
জোয়ান অবশ্য তেমনই ভাবে। যদিও তার বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলার বদভ্যাস আছে।
জানালার বাইরে ডার্স ও পেরি হাঁটাহাঁটি করছেন। এক দল ক্যাম্পারকে দিক-নির্দেশনা দিচ্ছেন। জোয়ান তাদের কয়েক জনকে মাত্র চেনে: ডনি ও মন্টিকে। ক্যাম্পারদেরকে নাম ধরে মনে রাখা কঠিন। তারা তো কেবল ভিড়ের মধ্যে মিলে যাওয়া, সাধারণত নোংরা তরুণ যাদেরকে দিনে তিন বেলা খাওয়াতে হয়, যাদের খাবারের উচ্ছিষ্ট পরে পরিস্কার করতে হয়। কাউন্সেলররা এদের বলেন ‘নোংরা’।
তবে কাউকে কাউকে আলাদা করে চেনা যায়। ডনি তার বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা। কনুই ও হাঁটু লম্বা-সরু। বড় বড় চোখদুটো সুগভীর নীল। এমনকি যখন সে খারাপ কথা বলে –খাওয়ার সময় তারা সবাই বলে, গোপনে বলে কিন্তু পরিচারিকারা যাতে শুনতে পায় সে রকম জোরে বলে—তখন সেটা অনেকটা ধ্যানের মতো কিংবা প্রশ্নের মতো হয়। যেন সে কথাগুলোকে মুখ থেকে বের করে দিচ্ছে, স্বাদ নিচ্ছে। অন্য দিকে মন্টি আবার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সীর ক্ষুদ্র রূপ। কাঁধদুটো এর মধ্যেই ব্যবসায়ীদের মতো ঝুলে পড়েছে। ভুড়িটা বেশ বড় হয়ে গেছে। জাঁকালো ভঙ্গিতে হাঁটে। জোয়ান ভাবে, মন্টি খুব মজার ছেলে।
মন্টি এখন হাতলে ভরানো পাঁচটা টয়লেট পেপারের রোল ও একটা ঝাড়ু বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বগ ডিউটিতে সব ছেলেই ঘর-দোর পরিস্কার করছে, পেপার পাল্টাচ্ছে। জোয়ান ভেবে পায় না পরিচারিকাদের ব্যক্তিগত রুমের বাদামি পেপার ব্যাগে থাকা ব্যবহৃত স্যানিটারি ন্যাপকিন দিয়ে তারা কী করে। সে মন্তব্যসমূহ কল্পনা করতে পারে।
ডার্স চিৎকার করে বলেন, ‘কোম্পানি…থামো!’ দলটি জানালার সামনে হঠাৎ থেমে যায়। আরও বলেন, ‘অস্ত্র…হাজির করো!’ ঝাড়ুগুলো তোলা হয়, টয়লেট পেপার রোলের কোনাগুলো মৃদু বাতাসে পতাকার মতো পতপত করে উড়তে থাকে। মেয়েরা হেসে ওঠে এবং হাত নাড়ে।
মন্টির স্যালুট নিরাবেগের। এটা তার মর্যাদার বেশ নিচে। বাইনোকুলারটা সে ভাড়া দিতে পারে। সে গল্পটাই এতক্ষণ পুরো ক্যাম্প জুড়ে। কিন্তু নিজের জন্য বাইনোকুলার ব্যবহার করার তার কোনও আগ্রহ নেই। সবাইকে সে সেটা জানিয়েছে। উন্নততর রুচির ইঙ্গিত দিয়ে সে বলে, ‘অন্তত এসব মেয়েদের জন্য না।‘
ডার্স নিজে হাসির স্যালুট দেন। তারপর দলটিকে নিয়ে যান। রান্নাঘরে গান গাওয়া থেমে গেছে। পরিচারিকাদের মধ্যে আলোচনার বিষয় এখন কাউন্সেলররা। ডার্সই সর্বোত্তম, সর্ব-প্রশংসিত, সর্ব-কাঙ্খিত। তার দাঁতগুলো সবচেয়ে সাদা। চুলগুলো সবচেয়ে সোনালি। তার দন্ত-হাসিটা সবচেয়ে যৌন-আবেদনময়ী। কাউন্সেলরদের বিনোদন হলে, যেখানে তারা বাসন-কোসন মাজার পর প্রতি রাতে যায়, যেখানে তারা নীল ইউনিফর্ম পাল্টিয়ে জিন্স পরে যায়, যেখানে ক্যাম্পারদের রাতের মতো বিছানায় রেখে যায়, সেখানে ডার্স এদের প্রত্যেকের সাথে পালাক্রমে ফষ্টিনষ্টি করেছেন। তাই আসলে কাকে স্যালুট দিচ্ছেন তিনি?
প্যাট মজা করে বলে, ‘আমাকে দিচ্ছে। আমার কি ইচ্ছে হয় না?’
লিজ বলে, ‘স্বপ্ন দেখতে থাক।‘
স্টিফ্যানি বাধ্যগতভাবে বলে, ‘হিলকে দিচ্ছে।‘ কিন্তু জোয়ান জানে হিলকে দিচ্ছে না। নিজেকেও না। দিচ্ছে রনেটকে। তারা সবাই সন্দেহ করে। কিন্তু কেউ বলে না।
স্যান্ডি বলে, ‘পেরি জোকে পছন্দ করে।‘
জোয়ান বলে, ‘করে না।‘ সে বলে বেড়িয়েছে যে, এরই মধ্যে তার ছেলেবন্ধু জুটেছে, আর তাই এসব প্রতিযোগিতা থেকে সে রেহাইপ্রাপ্ত। এর অর্ধেকটা সত্য। তার ছেলেবন্ধু আছে। কানাডিয়ান ন্যাশনালে এবারের গ্রীষ্মে পুরো মহাদেশ জুড়ে যাওয়া-আসা করার একটা চাকুরি হয়েছে তার। জোয়ান তার ছবি কল্পনা করে যে, তার ছেলেবন্ধুটি ট্রেনের পিছনে, কাবুসের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, সালাদ তৈরির ফাঁকে ফাঁকে ধূমপান করছে, গ্রামগুলোকে পিছনের দিকে সরে যেতে দেখছে। ছেলেবন্ধুটি নীল বলপয়েন্টের কলমের কালিতে দাগ টানা কাগজে তাকে চিঠি লেখে।খুবই চমৎকার—ঐ যে মাটি ও আকাশ। সূর্যাস্তগুলো অবিশ্বাস্য। তারপর অপর পৃষ্ঠায় একটা লাইন এবং নতুন তারিখ। আর রকি পর্বতমালার কথা বলে। জোয়ান একটু রাগ করে যে, সে শুধু সেসব জায়গার কথা আওড়ায় যেখানে জোয়ান কখনও যায়নি। তার কাছে মনে হয় এসব এক ধরণের পৌরুষত্ব প্রদর্শন। বন্ধুটি তো যে কোনও কিছু করার মতো স্বাধীন। চিঠিটা শেষ করে তুমি যদি থাকতে এখানে দিয়ে এবং কিছু বড় হাতের ‘এক্স’ আর ‘ও’ দিয়ে। এটা খুব বেশি আনুষ্ঠানিকতাক্লিষ্ট ঠেকে। যেন মাকে চিঠি লিখছে। যেন গালে একটা ঠোকর দিচ্ছে।
জোয়ান প্রথম চিঠিটা তার বালিশের নিচে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু জেগে উঠে দেখে তার মুখাবয়বে ও বালিশে নীল নীল দাগ লেগে আছে। চিঠিগুলো এখন সে বিছানার নিচে তার স্যূটকেসে রাখে। ছেলেবন্ধুটা দেখতে কেমন সেটা মনে করতে জোয়ানের কষ্ট হচ্ছে। একটা ছবি দ্রুত মনে আসে। তার মুখখানি বন্ধ হয়ে আছে। রাতের বেলা। তার বাবার গাড়ির সামনের আসনে বসে আছে। কাপড়-চোপড়ের খসখস শব্দ। ধূমপানের গন্ধ।
Be the first to comment