নদীও নারীর মতো
-সেলিম মিয়া
আকাশ কালো মেঘে এতটাই আচ্ছন্ন আর মেঘের কিনার ঘেঁষে আলোর এত ঝলকানি যে নদী এবার ওপরের দিকে মুখ না তুলে পারে না। চেয়ে চেয়ে তার শুধু মনে হচ্ছে সূর্য এতটা ধূমপান না করলেই পারত। আগুনের ধোঁয়াশায় বার বার প্রমাণ করার কী এত প্রয়োজন যে, তার বয়স নিদেনপক্ষে উনিশ? কিসের জন্য এ আচ্ছন্নতা? কেনই-বা এই ছলচাতুরী যদি ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকতে চায়? সেটা কি শুধুই মায়াবী আহ্বান? প্রশ্ন বয়ে যায় সদ্যযৌবনা নদীর মনে।
একদিন মেঘে মেঘে বিজলীপাতের পর তুমুল বর্ষণের সময় হিমালয় পর্বতমালার গর্ভ থেকে জন্ম নেয় নদী। সেখান থেকেই চুঁয়ে চুঁয়ে গড়ায় অন্য পর্বতের পায়ে এসে। এরপর খেলার ছলে নৃত্যের ভঙ্গিতে এঁকেবেঁকে চলে। বনের ডালপালা ও ফলমূল, বুনোহাঁস, পাখপাখালী, এমনকি মানুষের আবর্জনা ও উচ্ছিট্ট হয় তার খেলনা। ভাসায়, ডোবায়, ঘূর্ণিজলে ঘোরায়। এভাবে সব খেলনা যখন ফুরিয়ে যায়, তখন সে দু’পার ভাঙে। দু’পারের বন-বনানী ও ভিটেবাড়ির জিনিসপত্র তখন তার খেলনা হয়ে যায়। মনের সুখে খেলতে থাকে। যখন পাহাড়ের পাশ দিয়ে যায় কিংবা জিঞ্জিরামের মতো অন্যান্য ছোট নদীর সাথে পাহাড়ের পায়ে পায়ে ছুটে বেড়ায়, তখন মনের আনন্দে ছড়া কাটে:
নাম আমার জিঞ্জিরাম
পাহাড়ের পায়ে পায়ে হাঁটি অবিরাম।
পাহাড়ের যত অশ্রু আছে,
আমার বুকে আশ্রয় যাচে।
আমার চোখে কেঁদে সে পায় যত আরাম,
আমার বীণার তারে বাজে তার দুঃখ স্বরগাম।
ছড়া কাটে আর কলকলিয়ে জলনৃত্য করে ছুটে বেড়ায়। এমন আনন্দময় চলার মধ্য দিয়ে সে একটু একটু করে বড় হতে থাকে।
এভাবে খেলতে খেলতে এবং চলতে চলতে একদিন সে আবিস্কার করে নিজের অজানা রূপ যাকে আমরা বলি বয়ঃসন্ধিকাল। যে কালে জীবন অরূপের রত্নভাণ্ডার দেহকে উপহার দেয়। আর তার ভার এতটা আকস্মিক যে, সে আতঙ্কিত না হয়ে পারে না। কেননা এর জন্য তার দেহ প্রস্তুত থাকলেও মন প্রস্তুত নয়। শৈশবের কলকল ঘুঙ্ঘুর নৃত্য ও মেঘের সাথে কানামাছি খেলা এখন আর তাকে টানে না। এ বসন্ত ঋতু কোন সময়ে যে বিড়ালের মতো নিঃশব্দ চরণে তার জীবনে এসেছে সে ঠাহর করেনি। এ সময় সে একটা অজানা মায়া অনুভব করে তার রক্তের মধ্যে। যে মায়া তাকে দিনরাত টানে। সে টানে চলতে থাকে। বাতাসের সামান্য স্পর্শেও এখন তার শরীর শিহরিত হয়ে ওঠে। রাতের আকাশ, দিনের আলো, দুই তীরের বৃক্ষ-ফুল-পাখি সমেত প্রকৃতি তার মন-বীণায় নতুন ঝঙ্কার তোলে।
কত উঁচু-নিচু পথ বেয়ে, নিজের শরীর থেকে কত না রক্ত হাজার হাজার ফিনকি দিয়ে ঝরিয়ে সে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে, নিজের গতিপথ অক্ষত রেখেছে—শুধু সাগরকে দেখবে বলে! তার ইয়ত্তা নেই। সাগরের কথা সে অনেক শুনেছে মেঘের কাছে। মেঘ অবশ্য সাগরের গল্প শুনিয়েছে তার নিজের স্বার্থেই। সে বলেছে, সব নদী নাকি সাগরের সাথে মিশে যেতে চায়। বিপুল গর্জন তানে ঢেউয়ের পর ঢেউ তুলে প্রকাণ্ড ঊর্মিমালা পরিয়ে সাগর যে কোনো নদীকে বরণ করে নেয়। মেঘ তখন তাদের মিলনের তালে তালে দ্রুম দ্রুম করে তবলা বাজায় এবং ঝলমলে আলোকসম্পাত করে। এ রকম গল্প শুনতে শুনতে কখন যে সাগরের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া শুরু করে নদী নির্দিষ্ট করে তা জানে না। সেই সাথে ঈর্ষাও জাগে গোপনে ‘যে কোনো নদীকে বরণ করে নেয়’ কথাটা শুনে।
নদীর রূপের প্রতি মেঘের একটা দুর্নিবার আকর্ষণ আছে। তাই কারণে অকারণে নদীকে যেমন সঙ্গ দেয়, তেমনই ফাঁপরও দেয়। এই তো কিছুদিন আগে নদী শুকিয়ে যাচ্ছিলো প্রায় জলের অভাবে। মেঘ সব দেখেও কোনো সাহায্য করেনি। নদী মুমূর্ষু অবস্থায় পৌঁছালেই কেবল মেঘ ঝর ঝর করে ঝরে নদীকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে আনে। অথচ মেঘ ইচ্ছে করলেই এমন দুর্দশা তাকে পোহাতে হতো না।
চলার পথে নিঃসঙ্গতা জেঁকে বসলে নদী অন্যান্য শাখানদী ও উপনদীকে তার সাথে এক করে নেয় খেলার সাথী হিসেবে। কিন্তু সাগর যেন সেই সূর্যের মতোই। নদী তো সাগরকে দেখতে পায় না। এর সাথে মিলনের জন্য সে জন্ম থেকে যাত্রা করেই চলেছে। সে যাত্রা অক্ষত রাখতে কত কিনা করেছে। আকাশের দিকে চেয়ে চির-খুনসুটিমুখর মেঘের কাছে জল ভিক্ষা করেছে যখন তার উৎসমুখে জলের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তে তিরস্কার করে মেঘের মনে অবশেষে দয়া হয় যখন তার উদ্বৃত্ত জল থাকে। তাই বর্ষায় সে নদীকে তার বাড়তি অংশটুকু দান করে। ভিক্ষার উদ্বৃত্ত জল দিয়ে সে নিজের নিতম্ব ও বুকসহ গোটা দেহটাকে খানিকটা স্ফীত করতে কত মানুষকেই না সর্বশান্ত করেছে। কত মানুষ যে ভিটেছাড়া হয়েছে, হয়েছে ফসলসর্বস্ব জমিনহারা! তারা হয়তো সে জন্য তাকে তাদের সারা জীবন ধরে রাক্ষসী বলে গালিগালাজ করছে।
তাতে কী? জীবনের চক্র তো এমনই। অন্য জীবনকে নাশ করে বেঁচে থাকা। যে যত অন্যের ক্ষতি করে সে ততই হৃষ্টপুষ্ট হয়। কে-ই বা এর বাইরে। যারা মনে করে বাইরে তারা তো হিসেব কষে দেখে না যে তারাও এর বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে না। হিসেব কষলে দেখতে পাবে প্রকৃতি জগতে কীভাবে একজন আরেক জনকে খেয়ে খেয়ে নিজেকে টিকে রেখেছে। যদিও এ খাওয়ার মধ্যেও কারও না কারও কল্যাণ কোনো না কোনোভাবে নিহিত থাকে।
Be the first to comment