ফটোগ্রাফী কি শিল্প?
-শাহীনুর ইসলাম
প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে ‘শিল্প’ বলতে কী বোঝায় আগে তার একটি রূপরেখা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি। শিল্প কী? এ প্রশ্ন অনেক আগেই মানুষের মনে উদয় হয়েছিল এবং আজ অবধি সে মতের বিবর্তন চলছে।
শিল্পকে নানা জনে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। খ্রিষ্টেরও জন্মের প্রায় চারশ বছর আগে গ্রীক দার্শনিক প্লেটো বলেছেন- শিল্প প্রাকৃতিক বা মানবকৃত বস্তুর অনুকরণ, ‘আইডিয়া’-কে প্রকাশ করার সামর্থ্য তার নেই। নেই এই কারণে যে, আইডিয়া বিশেষ নিরপেক্ষ অস্তিত্ব নিয়ে বিশুদ্ধ সত্তায় অবস্থান করে। ফলে অনুকরণকেই আবার অনুকরণ করে। অবশ্য প্লেটো শিল্পের এ সংজ্ঞা থেকে শেষদিকে সরে এসেছিলেন।
আর তাঁর সুযোগ্য ছাত্র এরিষ্টোটল শিল্পকে পুরোপুরি মিমেসিস বা অনুকরণ বলে মনে করতেন। তাঁর মতে- শিল্প বিশেষের (particular) মাধ্যমে সামান্যকেই(universal) অনুকরণ করে। এজন্য তাঁর বক্তব্য বেশ খানিকটা যুক্তিগ্রাহ্য ছিল।
অনেকের মতে যা সুন্দর তাই শিল্প, কিন্তু সে মতে আমাদের পারিপার্শ্বিক অনেক বস্তুই সুন্দর অথচ তাদের আমরা শিল্প পদবাচ্য বলে মনে করি না। এক্ষেত্রে বলা যায়, সে বস্তুরাজি যতোটা না বুদ্ধির কৌশলে নির্মিত ততোটা ভাবের উপর ভর করে নয়। সাধারণত শিল্পের সহজ শর্ত হিসাবে ভাব ও বুদ্ধির অনুপাত ৬০ : ৪০ হিসাবে গ্রহনযোগ্য হতে পারে। তাই বুদ্ধির পরিমাণ বেড়ে গেলে সেক্ষেত্রে কাঙ্খিত বস্তুটি বাস্তবতার অবস্থায় পর্যবসিত হয়। হুবহু বাস্তবতাকে তো আর যাই হোক শিল্প বলা যায় না।
এবার দেখা যাক শিল্প সৃষ্টিতে কী প্রয়োজন। প্রথমেই একটি বস্তু এবং সে বস্তু সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। দ্বিতীয়ত, সে বস্তুকে শিল্পের স্তরে পৌঁছে নিতে একটি শিল্পীসত্তা আবশ্যক। তাহলে ‘শিল্পের স্তর’ বলে যে ব্যাপারটা তা বস্তুর আসল রূপ বা অন্তর্সত্তা। এর কারণ কোন বস্তুকে আমরা যখন যেভাবে দেখি তা মূলত আলোর অবদান। আলোর কারণেই বস্তুকে বিভিন্ন রঙে বিভিন্ন ঢঙে আমরা দেখে থাকি। বস্তুর এই বহির্সত্তা সম্পর্কে শিল্পীর যেমন পুরাদস্তুর জ্ঞান থাকা প্রয়োজন তেমনি তার অন্তর্সত্তায় পৌঁছানোর নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস কাম্য।
তারপরও শিল্পী তাঁর চিত্রে, কাব্যে, সঙ্গীতে বা আলোকচিত্রে সৌন্দর্যের যে রূপটি ফুটিয়ে তোলেন, সেও আপেক্ষিক। কারণ, শিল্পীকে বস্তুসত্তা থেকে শিল্পসত্তায় নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু প্রকৃত রূপ যাকে ধরার জন্য শিল্পী অমন অস্থির ও ব্যাকুল হয়ে ওঠেন, তা বস্তুত অধরাই থেকে যায়। তবুও অরূপকে রূপে, অভাবকে ভাবে ধরার জন্য শিল্পীর নিরন্তর প্রয়াস চলে। তেমনটি করতে গিয়ে শিল্পী কখনও আকারের বিকার ঘটান, ফর্মের ভাংচুর করেন, ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণ ও শৈলী তৈরি করেন। এভাবে অরূপকে রূপে ধরতে শিল্পী চিত্রে আলো-ছায়ার সমন্বয়ে এক মায়ার (illusion) জগৎ সৃষ্টি করেন- যা হুবহু বাস্তবতা থেকে ভিন্ন অথচ শিল্পসত্তা থেকে দূরে।
শিল্পকে অনেকেই নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে আধুনিক যুগে এসে শিল্পকে মোটামুটি সংজ্ঞায়িত করা হয়- creative interpretation of life and reality- হিসাবে। এখানে দুটো জিনিস- একটা বস্তুজগৎ, জীবন ও বাস্তবতাকে পর্যবেক্ষণ করা, উপলব্ধি করা এবং তা থেকে নির্বাচন ও বর্জন করা। দ্বিতীয়ত, সেই জীবন ও বাস্তবতাকে সৃজনশীলতার রস দিয়ে জারিত করা ও ব্যাখ্যা প্রদান করা।
এই যদি হয় শিল্পের ধারা, তাহলে ফটোগ্রাফীকে কী শিল্প বলা যায়? আলোকচিত্র তো শুধু আমাদের দৈনন্দিন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, সাংগঠনিক, রাজনৈতিক কিংবা নিছক ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। তাহলে আলোকচিত্রণ কিভাবে শিল্প পদবাচ্য হবে? এমনটি হয়তো অনেকরই ভাবনা ও মত। কিন্তু আলোকচিত্রণ নেহায়েৎ প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়াও শুধু যে দৃশ্যরস ও নান্দনিক বোধ সৃষ্টি করতে পারে, তা-ও হয়তো অনেকের অজানা।
আলোকচিত্রণকে শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি দিতে যখন স্বয়ং শিল্পীদের মধ্যেই সঙ্কট দেখা যায়, তখন আর পাঁচ-দশ জনের কথা বলাই বাহুল্য। সংগীত, চিত্রকলা, কাব্য, নাটক, ভাস্কর্য ইত্যাদি যখন বহু আগে থেকে শিল্প বলে পরিগণিত, ফটোগ্রাফীর সেখানে শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। একটি ভাল ছবি সৃষ্টি শুধু যন্ত্রগুণের উপর নির্ভর করে না; তাতে ভাব, অনুভূতি, নান্দনিক বোধের প্রয়োজন পড়ে- যা অন্যান্য শিল্প মাধ্যমেও আবশ্যক।
তবে আশার কথা এই যে, ফটোগ্রাফী আজ অবশ্যই শিল্পের স্তরে উন্নীত- অবশ্য তা শুধু তার উন্নত মানের সূক্ষ্ম কারিগরি গুণসম্পন্ন ক্যামেরা, প্রযুক্তি কৌশল ও ডার্করূম টেকনিকের কারণেই নয়, নান্দনিক গুণের কারণেও বটে। ফটোগ্রাফী বা আলোকচিত্রণকে শিল্প না বলার পেছনে যে দ্বিধাবোধ, সেই দ্বিধাবোধের পেছনেও অনেকখানি দীর্ঘকালের সংস্কার ও প্রচলিত ধ্যান-ধারণা কাজ করে থাকে। আলোকচিত্রণের যেমন নিজস্ব শিল্পগুণ রয়েছে, তেমনি বিশেষ visual impact রয়েছে। ব্যবহারিক প্রয়োজন ও শিল্পের দেউড়ি পেরিয়ে ফটোগ্রাফী শিল্পকলার পরিপূরক হিসাবে কাজ করে।
দেখা যায়, একটি আলোকচিত্র একটি চিত্রশিল্প সৃষ্টিতে অনেক সময়-সংকোচনে সহায়তা করে। প্রতিদিনের দেখা অনেক জিনিসের মধ্যে যে দৃশ্যটি আমার কাছে ভাল লাগলো তা যদি আমি ক্যামেরায় ধারণ করে রাখি, তবে তা পরে অন্য শিল্প নির্মাণে কাজে দেবে। কেননা কোনো বস্তু যতোই ভাল লাগুক, তার হুবহু রূপ তো আর স্মৃতিতে রাখা সম্ভবপর হয় না। এভাবে আলোকচিত্র শিল্পকলার পরিপূরক ভূমিকাটিও পালন করে।
এছাড়া ফটোগ্রাফী মানুষের ব্যবহারিক জীবনে যত কাজে আসে, অন্য কোন শিল্প মাধ্যম যথা- সঙ্গীত, কাব্য, নাট্যকলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদি তার ধারের কাছেও নেই। মহাশূন্য থেকে শুরু করে পৃথিবীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জীবাণু, জীবজন্তুর রোগ বালাই নির্ধারণ থেকে মানুষের রোগ বালাই সনাক্তকরণ প্রভৃতি কাজে আলোকচিত্রণের ভূমিকা কল্পনাতীত।
অবশ্য শিল্প তো শিল্পই। তার আবার ব্যবহারিক প্রয়োজননির্ভরতার দরকার কী? যদি নিত্যদিনের কাজকর্মেই লাগলো, তবে তো শিল্প আর শিল্প থাকলো না। এদিক থেকে বলা যায় ফটোগ্রাফীর সে শিল্পগুণও রয়েছে। আর সঙ্গীত, শিল্পকলার মত আলোকচিত্রণও আধুনিক যুগে একটি স্পেশালাইজড সাবজেক্ট। তাছাড়া, উন্নত দেশসমূহে আলাদা ইনসটিটিউট-ই রয়েছে শুধুমাত্র আলোকচিত্রণ বিষয়ে পাঠদান করার জন্য। অবশ্য এখন আর ফটোগ্রাফী বলে একক কিছু শেখানো হয় না। এর রয়েছে আবার অনেক শাখা যেমন- Advertising Photography, Photojournalism, Fine Art Photography, Underwater Photography, Medical Photography ইত্যাদি।
শিল্পকলার ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় ভাবসম্পদ। কিন্তু শিল্প হিসাবে আখ্যায়িত হতে হলে আলোকচিত্রণকে অবশ্যই ভাবের সাথে মূখ্যত টেকনিক্যালি সমৃদ্ধ হতে হবে । কেননা একটি সার্থক আলোকচিত্র সৃষ্টি করতে গেলে তা অনেকটাই নির্ভর করে লেন্সের গুণাগুণ, ক্যামেরা চালানো, বিরচন, দৃষ্টিকোণ নির্বাচন, ফিল্মের কোয়ালিটি, আলোক নিয়ন্ত্রণ এবং সবশেষে পরিস্ফুটন ও ডার্করূম টেকনিক দক্ষতার উপর। উপরন্তু, ডার্করূম টেকনিক বা ফটোশপের মাধ্যমে একটি আলোকচিত্রকে অত্যন্ত আকর্ষণীয় creative image -এ রূপান্তরিত করা যায়- যা দেখলে হাতে আঁকা কোন ছবি বলে ভ্রম হয়। এ রকম কয়েকটি কৌশল হচ্ছে- reticulation, posturization, pseudo-solarizaion, sand witch printing, bas-relief, photo-montage, pen and ink ইত্যাদি। আলোকচিত্রে নান্দনিকতার সাথে সাথে টেকনিক্যাল দিকটা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। তাই অনেকে ফটোগ্রাফীকে বলে থাকে- combination of art and technology.
Be the first to comment