ওয়াইল্ডারনেস টিপস – অনুবাদ

গল্প

ওয়াইল্ডারনেস টিপস

ওয়াইল্ডারনেস টিপস

মূল: মার্গারেট এটউড

অনুবাদ: সেলিম মিয়া


কত বছর বয়স হবে রোলান্ডের—নয়? দশ? এ বয়সে প্রুকে সে মেরে ফেলেছিল প্রায়। সময়টা ছিল গ্রীষ্মকাল। ওয়াল্ডারনেস টিপস  এর কারণে সে হতে চেয়েছিল ইন্ডিয়ান। বইয়ের তাক থেকে এ বইটা চুরি সে বাইরে কাঠের চালার পিছনে নিয়ে যেত। নিয়ে গিয়ে পাতার পর পাতা উল্টাত। ওয়াল্ডারনেস টিপস বইটায় লেখা ছিল বনের মধ্যে কীভাবে আপনি নিজে নিজে বাঁচবেন। এ জিনিসটাই সে করতে চেয়েছিল। কীভাবে আশ্রয় নির্মাণ করতে হয়, কীভাবে চামড়া থেকে কাপড় বানাতে হয়, কীভাবে খাবার উপযোগী লতাপাতা খুঁজে পেতে হয়। ডায়াগ্রামও ছিল। ছিল পাতা, বীজ ও প্রাণীদের চলার পথের কালি ও কলমের অঙ্কন। আরও ছিল বিভিন্ন ধরণের প্রাণীর মলের বর্ণনা। তার মনে আছে প্রথম বার যখন সে ভাল্লুকের কিছু মল দেখতে পেয়েছিল। সদ্য ত্যাগ করা ও দুর্গন্ধযুক্ত এবং ব্লুবেরির মতো বেগুনি রঙা ছিল। দেখে সে বেশ ভয় পেয়েছিল।

ইন্ডিয়ানদের নিয়ে অনেক কিছু ছিল, যেমন—তারা কত মহৎ ছিল, কত সাহসী ছিল, কত বিশ্বস্ত, পরিচ্ছন্ন, শ্রদ্ধাশীল, অতিথিপরায়ণ ও সম্মানীয় ছিল। ( এ শব্দগুলোও এখন সেকেলে, অপ্রচলিত শোনায়। শেষ সময়টা কখন ছিল যখন রোলান্ড কাউকে সম্মানীয় বলে প্রশংসিত হতে শুনেছিল?) তারা নিজেদের রক্ষা করতেই শুধু আক্রমণ করত। তাদের জমি চুরি হওয়া থেকে বাঁচাতে আক্রমণ করত। তারা ভিন্নভাবেও হাঁটত। ২০৮ নং পৃষ্ঠায় একজন ইন্ডিয়ান ও একজন শাদা মানুষের পদচিহ্নের ডায়াগ্রাম ছিল। শাদা মানুষটির পায়ে ছিল হবনেইল্ড বুট, আর আঙ্গুলগুলো ছিল বহির্মুখী ও তীক্ষ্ন। ইন্ডিয়ানের পায়ে ছিল মোকাসিন, আর তার পায়ের পাতা সোজা সামনের দিকে বাড়ানো ছিল। এরপর থেকেই রোলান্ড তার পা সম্পর্কে সচেতন হয়। তার পায়ের আঙ্গুলগুলো এখনও কিছুটা উল্টানো আছে। সে মনে করে যে, জিনগতভাবে প্রগ্রামকৃত অবিসম্ভাবীরূপে ছোট ছোট পদক্ষেপে হাঁটার বিপরীতে আঙ্গুলগুলো এমন করে রেখেছে সে।

সেই গ্রীষ্মে গোসলের পোশাক হিসেবে চায়ের তোয়াল দিয়ে নেংটি পরে অগ্নিস্থান থেকে কয়লা দিয়ে মুখে নকশা করে এবং ফাঁকে ফাঁকে প্রুর রঙ-তুলির বাক্স হতে লাল রঙের পেইন্ট মেখে ছুটে বেড়িয়েছিল। জানালার বাইরে সে তাকিয়ে ছিল। ভেতরে শুনছিল। ধোঁয়ার সংকেত দেওয়ার চেষ্টা করতে নৌঘরের কাছে জন্মানো এক থোকা ঘাসে আগুন লাগিয়েছিল। কিন্তু ধরা খাওয়ার আগেই নিভিয়ে দিয়েছিল। তার বাবার একটা বুট থেকে ধার করা চামড়ার ফিতাসহ লাঠির হাতলে আয়তাকার একটা পাথর ছুড়েছিল। তার বাবা তখন জীবিত ছিলেন। প্রু যে ডকে বসে পানিতে পাদুটো ঝুলিয়ে কৌতূককর বই পড়ত, তার ওপর গোয়েন্দাগিরি করত সে।

রোলান্ডের কুঠারটা ছিল পাথরের। সে তাকে মাথায় কোপ দিয়ে মেরে ফেলতে পারত। অবশ্য সে প্রু ছিল না। ছিল কাস্টার। সে ছিল বিশ্বাসঘাতকতা, ছিল শত্রু। কুঠারটা তুলেছিল পর্যন্ত। দেখছিল ডকের ওপর পড়া তার নিজের ছায়ার বিশ্বাসযোগ্য আলো-আঁধারি চিত্র। পাথরটি পড়ে গিয়েছিল তার খালি পায়ে। ব্যথায় সে চিৎকার দিয়েছিল। প্রু ঘুরে তাকে সেখানে দেখেছিল এবং মুহূর্তের মধ্যে আঁচ করেছিল সে কী করতে যাচ্ছে। আর নির্বোধের মতো হেসেছিল। তখনই সে প্রুকে প্রায় খুন করেছিল। অন্য জিনিস—কুঠারটা ছিল কেবল একটা খেলা।

পুরো বিষয়টাই ছিল কেবল একটা খেলা। কিন্তু সে আঘাত পেলে ছেড়ে দিয়েছিল। বইয়ের ধরণের এ রকম ইন্ডিয়ানে সে প্রবলভাবে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল। তাদের অস্তিত্ব থাক সেটা তার প্রয়োজন ছিল।

গতকাল গাড়ি চালানোর সময় একটা ব্লুবেরি স্ট্যান্ডে তিনজন প্রকৃত ইন্ডিয়ানের একটা দলের পাশ দিয়ে গিয়েছিল সে। অন্য সবার মতো তারা জিন্স, টি-শার্ট ও রানিং জুতা পরে ছিল। তাদের একজনের কাছে ছিল ট্রান্জিস্টার রেডিও। স্ট্যান্ডের পাশে পার্ক করা ছিল মেরুন রঙের নিপাট একটা মিনিভ্যান। তা তাদের কাছ থেকে সে কী প্রত্যাশা করেছিল, পালক? পালক তো কবেই গেছে, হারিয়েছে, নষ্ট হয়েছে, তার জন্মের বহু বছর আগে।

সে জানে এসব বাজে। মোটের ওপর সে তো একজন মাছি মারা কেরানি। বাস্তবতার কঠোর মুদ্রা নিয়ে তার কাজ। প্রথমত যা কখনই আপনার ছিল না তা কী করে আপনি হারান? (কিন্তু আপনি হারাতে পারেন, কারণ ওয়াল্ডারনেস টিপস এক সময় তার ছিল, যা সে হারিয়েছে। চল্লিশ বছর পর মধ্যাহ্ন ভোজের আগে আজকে সে বইটি খুলেছিল। এক সময়ের নির্দোষ, বস্তাপচা শব্দগুলো তাকে অনুপ্রাণিত করত। বড় হাতের ‘এম’ দিয়ে ম্যানহুড, সাহস, সম্মান। বন্যদের স্পৃহা। সেটা ছিল সরল ও অকপট, জাঁকালো, হাস্যকর। ছিল ধূলা।)

কুঠার দিয়ে রোলান্ড কাঠ চেরে। চেরার আওয়াজটা তার বামে ছোট নালার ওপারে গাছের মধ্য দিয়ে চলে যায়। গিয়ে শিলার উচু খাড়িতে আছড়ে পড়ে। হালকা একটু প্রতিধ্বনি হয়। এ আওয়াজ পুরান, পরিত্যক্ত আওয়াজ।

পোর্শিয়া বিছানায় শুয়ে রোলান্ডের কাঠ চেরার আওয়াজ শুনতে শুনতে একটুখানি ঘুমায়। ঘুমানো বলতে সব সময় সে যেমনটা করে তেমনভাবে একটু ঘুমায়। এ রকম হালকা ঘুম এক সময় তার মা বলবৎ করেছিল। এখন সে শুধু সম্পাদন করে। সে যখন ছোট ছিল, তখন এখানে শুয়ে থাকত। প্রুর কাছ থেকে দূরে নিরাপদে তার বাবা-মায়ের সাথে ডবল বিছানায় শুয়ে থাকত। এ বিছানাটি এখন তার এবং জর্জের। প্রু সব ধরণের জিনিস নিয়ে চিন্তা করত। দেবদারু ছাদের গিট্টুতে মুখাবয়ব ও প্রাণীদের আকৃতি দেখত সে। আর তাদের নিয়ে গল্প বানাত।

এখন শুধু যেসব গল্প বানায় সে তা জর্জকে নিয়ে। জর্জ নিজেকে নিয়ে যে গল্প বানায় তার চেয়ে সম্ভবত আরও বেশি অবাস্তব প্রুর গল্পগুলো। তবে আসলেই জানার কোনও উপায় নেই প্রুর। কেউ কেউ এমনিতেই মিথ্যা বলে, কেউ কেউ বলে না। আর যারা বলে না  তারা যারা বলে তাদের দয়ার ওপর থাকে।

যেমন—প্রুর কথাই ধরুন। সে জ্বলন্ত মিথ্যাবাদী। সব সময়ই মিথ্যা বলে এসেছে। মিথ্যা বলাটা সে উপভোগ করে। ছোটবেলায় সে বলত, ‘দেখ, তোমার নাক থেকে ইয়া বড় শ্লেষ্মা আসছে।‘ আর পোর্শিয়া এতে ওয়াশরুমের আয়নার দিকে দৌড় দিত। কিছুই ছিল না। কিন্তু প্রু যে বলেছে, তাই যেমন করেই হোক এটাই সত্য। আর পোর্শিয়া নাক ঘষে ঘষে অদৃশ্য ময়লাকে ধুয়ে বের করে দিত। প্রুর হাসি তখন দ্বিগুণ হত। পামেলা বলত, ‘ওকে বিশ্বাস করো না। এমন চোষক হয়ো না।‘ (তখন তাদের প্রধান একটা শব্দ, যা সে ললিপপ, মাছ, মুখের জন্য ব্যবহার করত।) কিন্তু মাঝে মাঝে প্রু যা বলত তা সত্য হত। তাই আপনি কীভাবে জানবেন?

জর্জও একই রকম। পামেলার চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জর্জ নিজের প্রতি তার বিশ্বাসের ঘাটতির দরুণএমন কোমলভাবে, এমন আন্তরিক অনুভূতির সাথে, এমন পরোক্ষ বিষাদের সাথে মিথ্যা বলে যে পামেলা তাকে প্রশ্ন করতে পারত না। তাকে প্রশ্ন করলে পামেলা সংশয়বাদী ও রুক্ষ্ম হয়ে যাবে। তাকে বরং চুমু খাওয়া হোক। তাকে বরং লালিত করা হোক। সে বরং বিশ্বাস করুক।

জর্জ ও প্রু সম্পর্কে সে অবশ্য শুরুতে জানত। প্রুই জর্জকে প্রথমে এখানে এনেছিল। কিন্তু কিছুদিন পর জর্জ তার কাছে শপথ করেছিল যে প্রুর সাথে জিনিসটা সিরিয়াস ছিল না। আর তাছাড়া সেটার ইতি ঘটেছিল। আর প্রু নিজেই মনে হয় বিষয়টা পাত্তা দিত না। তার ইঙ্গিত ছিল যে, সে তো ইতোমধ্যেই জর্জকে পেয়ে গিয়েছিল, পোশাকের মতো তাকে ব্যবহার করেছিল। পোর্শিয়া যদি এর পরে জর্জকে চাইত, তবে সেটা তার কাছে কিছুই ছিল না। সে বলেছিল, ‘নিজেই চেষ্টা করে দেখো। ঈশ্বর জানেন জর্জকে নেওয়ার মতো এখনও যথেষ্ট আছে।‘

প্রু যেভাবে করত, পোর্শিয়া সেভাবে জিনিসগুলো করতে চাইত। হাত নোংরা করতে চাইত। তীব্র কিছু একটা, তারপর থাকত উদাসীন নাকচ। তবে তার বয়স খুবই অল্প ছিল। দক্ষতা ছিল না। জলাশয় থেকে উঠে এসে জর্জের হাতে সানগ্লাস দিয়ে দিত। আর জর্জ তার দিকে ভুলভাবে তাকাত। প্রবল আবেগে নয়, শ্রদ্ধায়। স্পষ্ট এক স্থির চাহনি যাতে কাম ছিল না। সেই রাতে নৈশভোজের পর জর্জ যথাযথ ভদ্রতার সাথে বলেছিল, ‘ এখানকার সব কিছু আমার কাছে এত নতুন। আমি চাই তুমি তোমার চমৎকার দেশের জন্য আমার পথনির্দেশক হও।‘

পোর্শিয়া বলেছিল, ‘আমি? আমি কিছু জানি না। প্রু হলে কেমন হয়?’ ইতোমধ্যেই সে অপরাধ বোধে ভুগছিল।


৩য় পর্ব                                                                                                                      শেষ পর্ব

Be the first to comment

Leave a Reply

Your email address will not be published.


*